রাজধানী ঢাকার ১৩টি থানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে মামলার নথিপত্র ও আলামত ধ্বংস হওয়ায় তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ও পরদিন (৫ ও ৬ আগস্ট) রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রাথমিক হিসাবে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, পল্টন ও ওয়ারী থানায় ১ হাজার ২২৬টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। অন্য থানাগুলোর নথিপত্র এবং আলামতের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনও প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে ৫০টি থানা থাকলেও সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে ২১টি থানায় ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ১৩টি থানা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুড়ে যাওয়া থানাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ভাটারা, ওয়ারী এবং খিলক্ষেত থানা।
মিরপুর মডেল থানা: ৬৬০টি মামলার নথি এবং ২৩০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানার নিবন্ধন খাতা ও কেস ডকেটসহ প্রয়োজনীয় সব নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় তদন্তের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম জানান, মামলার নথিপত্র পুনরায় তৈরি করতে সময় লাগবে এবং এর ফলে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে।
মোহাম্মদপুর থানা: ৮৯টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। তবে কতগুলো মামলার আলামত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিবন্ধন খাতা পুড়ে যাওয়ার কারণে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান ওসি ইফতেখার আহমেদ।
বাড্ডা থানা: ১৩৭টি মামলার নথি এবং ১৬০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানার ওসি জানান, এই থানার বিভিন্ন মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে যাওয়ায় তদন্তে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিচ্ছে।
শেরেবাংলা নগর থানা: এখানকার সব নথিপত্র এবং প্রায় দেড় শতাধিক আলামত পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া আলামতের মধ্যে মাদক, গাঁজা, ইয়াবা এবং ফেনসিডিলও রয়েছে, যা মামলার প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা হয়েছিল।
আদাবর থানা: ৭৬টি মামলার নথি এবং ১০০টি আলামত পুড়ে গেছে। নিবন্ধন খাতা ধ্বংস হওয়ায় তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নজরুল ইসলাম।
পল্টন থানা: ১৯০টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। তবে থানার নিবন্ধন খাতা পুড়ে যাওয়ায় আলামতের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান ওসি মোল্লা মো. খালিদ।
ওয়ারী থানা: ৭৪টি মামলার নথি এবং ২১৫টি আলামত পুড়ে গেছে ও লুট হয়েছে। তদন্তে এই ক্ষতির প্রভাব বড় আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শ্যামপুর থানা: ২৩৯টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে। ওসি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মামলার নথি এবং আলামতের তালিকা প্রস্তুত করার কাজ চলছে।
অন্য থানা: যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলগাঁও এবং খিলক্ষেত থানার ওসিরা জানিয়েছেন, এই থানাগুলোয় লুট হওয়া, পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত মামলার নথি এবং আলামতের হিসাব করা হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, যেসব মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে, সেগুলো ডিএমপির ক্রিমিনাল ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) থেকে পুনরুদ্ধার করা হবে। সিডিএমএসে ডিএমপির ৫০ থানার মামলার তথ্য সংরক্ষিত আছে। তিনি আরও বলেন, যেসব আলামত পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আদালতের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, থানাগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত নথিপত্র এবং আলামত পুনরুদ্ধারে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এছাড়াও, আদালতের রায়ে যেসব আলামত ধ্বংস করার নির্দেশ ছিল, সেগুলোও পুনরায় যাচাই করা হবে। ডিএমপি সদর দপ্তরে মালখানা না থাকায় থানাগুলোর আলামত রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অগ্নিকাণ্ডে শুধু মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে না, বরং পুলিশ প্রশাসনের নথিপত্র এবং আলামত সংরক্ষণের পদ্ধতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে, থানাগুলোর নিরাপত্তা ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মালখানা স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। তাই থানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন করে ব্যবস্থা নেওয়া, ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি এবং প্রমাণাদি সংরক্ষণের নতুন পদ্ধতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুক্ত প্রকাশ
প্রতিবেদন: সম্পাদকীয় বিভাগ
0 মন্তব্যসমূহ