গাজায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংঘাতের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান বিমান হামলায় প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য সাধারণ ফিলিস্তিনি। শুক্রবার ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন স্থানে তীব্র বিমান হামলা চালায়, এতে অন্তত ৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সূত্র। এসব হামলায় বহু লোক আহত এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। একদিকে গাজার নিরীহ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার, অন্যদিকে পুরো অঞ্চলের জন্য তৈরি হয়েছে এক গভীর মানবিক সংকট।
শুক্রবারের হামলায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হালিমা আল-সাদিয়াহ স্কুলে। এই স্কুলটি আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, যেখানে গাজার বাসিন্দারা ইসরায়েলি হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু স্কুলটি লক্ষ্য করে চালানো হামলায় আশ্রয় নেওয়া ৮ জন নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্কুলটি পরিষ্কারভাবে বেসামরিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও সেটি ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার শিকার হয়।
নুসেইরাত শরণার্থী শিবির, যা গাজার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, তাও ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণের বাইরে থাকেনি। শুক্রবারের হামলায় শিবিরে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এসব শরণার্থী শিবিরে সাধারণত গাজার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষরা আশ্রয় নেয়। এমন অবস্থায় এসব স্থানে হামলা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
গাজা ছাড়াও সহিংসতা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিম তীরে। বেআইনি ইসরায়েলি বসতির বিরুদ্ধে পশ্চিম তীরের বেইতা শহরের নিকটবর্তী এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নেন তুর্কি-আমেরিকান কর্মী আয়েশেনুর এজগি এগি। মাত্র ২৬ বছর বয়সী এই মানবাধিকার কর্মীকে বিক্ষোভ চলাকালে ইসরায়েলি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। আয়েশেনুর এজগি এগির মৃত্যু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দার ঝড় তুলেছে, এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন নিয়ে চলমান সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে।
পশ্চিম তীরে সংঘাতের শিকার হয়ে গত এক সপ্তাহে বহু সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ১৩ বছর বয়সী বানা আমজাদ বাকর, যিনি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। ওয়াফা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যা শিশুদের জীবনকেও বিপন্ন করে তুলেছে।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় এখন পর্যন্ত ৪০,৮৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৯৪,৪৫৪ জন আহত হয়েছেন। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মানবিক সহায়তার সংকট তীব্র হওয়ায় আহতদের চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১,১৩৯ জন নিহত হন। এ ঘটনার পর থেকেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় তীব্র পাল্টা হামলা শুরু করে, যার ফলে ক্রমেই বাড়ছে সহিংসতার মাত্রা। হামাসের এ হামলা ইসরায়েলে নিরাপত্তার বড় প্রশ্ন তুলেছে এবং গাজার ওপর ইসরায়েলি প্রতিশোধমূলক হামলার কারণ হিসেবে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে ক্রমাগত যুদ্ধবিরতি এবং সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হলেও, মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। গাজার সাধারণ মানুষ, যারা ইতোমধ্যেই সংঘাতের তীব্রতায় ক্ষতিগ্রস্ত, তারা এক আশ্রয় থেকে অন্য আশ্রয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শিশু, নারী, বয়স্কসহ সকলেই এক অভূতপূর্ব মানবিক সংকটের মুখোমুখি।
গাজায় চলমান এই সহিংসতা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে সকল পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধান বের করা ছাড়া গাজার সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
মুক্ত প্রকাশ
প্রতিবেদন: আন্তর্জাতিক ডেস্ক
0 মন্তব্যসমূহ